সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১২

সত্যগোপন ও সম্পর্কের পরিণতি!




.
: “কেমন আছ?”
: “হ্যাঁ এইতো আছি!”...দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে উঠে, “যেরকম থাকি তোমার খবর কি?”
: “আমি বাড়ি এসেছি তোমার সমস্যা কি মিটেছে?”
: “...নাহ! তো ডাক্তার দেখাতেই চায় না বলে আগেও নাকি দেখিয়েছে
: “আগে মানে কবে?”
: “ঐযে যখন অস্ট্রেলিয়ায় ছিলো তখন থাক বাদ দাও কথা” ...বলে আবারো ছোট একটা শ্বাস গোপনের চেষ্টা!!
: “তোমার কণ্ঠস্বর কেমন যেন শুনাচ্ছে কি হয়েছে বলো তো আমাকে
এরপরে কান্নার শব্দ শুনা যায় শুধু অনেকক্ষণ ধরে কোন কথা নেই মনার সমস্ত না বলা কথা যেন কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে স্রোতস্বীনি নদীর মত বয়ে চলল কিছুক্ষন
দাঁড়িয়ে আছে উজ্জ্বল জ্যোতস্নালোকিত বারান্দার এক কোনে, ঘরের লাইট নেভানো বারান্দার দরজাটা বাইরে থেকে সামান্য ভেজানো দরজার সাথে ওর বেড রুম কান্নার দমক কিছুটা হালকা হয়ে যাওয়ার পর খেয়াল করলো দরজার ফাঁকে একটা বিশাল ছায়া ওই ছায়া কার তা না দেখেও বলে দিতে পারে

.
মোবাইলে ফোন এসেছে মনা গোসল করতে করতে পানির শব্দ ছাপিয়ে শুনতে পেল একবার দুবার তিনবার বাজছে ওর নিজের ফোনকে করছে এতবার! জরুরী কিছু?”
অন্যদিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি গোসলখানা হতে বের হয়ে আসলো মনা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো, কোন মিসকল নেইকি ব্যাপার! আমি তো শুনলাম, আমার ফোন বাজছেবলে কল হিসটরি চেক করে দেখতে পেল ঠিকই তিনবার ফোন করেছিল শিমুল
শিমুল ফোন করেছিল! কেন?”
ভাবতে ভাবতে দেখলো, সাজিদ বারান্দা থেকে ঘরে প্রবেশ করছে চেহারায় কেমন যেন ভাব
এসে বসতেই মনা জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আমার ফোন ধরছিলা?”
-“হ্যাঁ দেখলাম
-“কেন?”
-“দেখলাম, কে ফোন করছে তোমাকে
শুনে রাগে গা জ্বলে উঠলো মনারঅনুপস্থিতিতে কারো জিনিসে নজর বুলানো যে ঠিক না তা তুমি জানো না?”
সাজিদ কিছু না বলে উঠে চলে গেলো
ঘরে শাশুড়ি আর সাজিদের কথোপকথনের শব্দ শুনতে পেল সে

.
: “তোমরা আগামীকাল মুক্তিসেনা কবিতাটি মুখস্ত করে আসবে
: “জ্বী, আপা
ক্লাসের ঘন্টা পরলে মনা ব্যাগ গুছিয়ে হেঁটে টিচার কমন রুমে চলে আসলো
:“কিরে মনা, মুখ শুকনো কেমন আছিস?”
:“নাসিমা আপা, এভাবে আর চলে না
:“ তুই তোর হাজবেন্ডকে বুঝা ভালো করে বুঝালে সে নিশ্চয়ই একসময় বুঝবে।“
কিভাবে বুঝাবে? আর কতবার! কতভাবে! বিয়ের দুবছর পেরিয়ে গেছে!” উত্তরটা দিল মনে মনে, “ বুঝাতে বুঝাতে লুছনী হয়ে যাচ্ছি!”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানপিটে তুখোড় ছাত্রী ছিলো মনা অনার্স, মাস্টার্সে প্লেস নিয়ে পাশ করেছে জীবনের কোন অধ্যায়ে সেকেন্ড ডিভিশন নেই খুব সুন্দরী না হলেও নজর কাড়তো সবারই সিনিয়র জুনিয়র অনেক ছেলেরই স্বপ্নে হানা দিতো অনেকেরই ঘুম হারাম করে দেওয়া মনার ব্যক্তিগত জীবনে ভালোবাসার বিশেষ একজন ছিলো অন্য সব মেয়ের মতই বিশ্ববিদ্যালয় পাশের পর ঘর বাঁধার স্বপ্ন ছিলো ওরও কিন্তু, কোন এক অজ্ঞাত কারণে হাসানের সাথে ওর বিয়েটা হলো না
হাসান অন্যত্র বিয়ে করে ফেললো ওকে না জানিয়েই। বিয়ে করে হাসান খুশি থাকলেও মনা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলো ওকে নিয়ে বাবা-মার চিন্তার শেষ ছিলো না কি করবে, কোথায় বিয়ে দিয়ে মেয়েটার জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে দুজনে পৃথিবী ছাড়তে পারবে সেই ভাবনা ছিলো সবসময়
এর মধ্যে মনার বাবা হালিম সাহেবের বড়ভাইয়ের বউ বড় ছেলেকে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য দেশে ফিরলে ওঁরা মনাকে দেখে মুগ্ধ হয় মনা তখন প্রেমের বেদনা ভুলে কিছুটা ধাতস্থ বিয়ের ব্যাপারে নিজেও একটু আগ্রহী
তারপর আর কি! ছেলে বাইরে থাকে, সেখানকার ওষুধ কম্পানীতে চাকরী করে, বছরে দুবার দেশে আসে মফস্বল শহরের মেয়ের জন্য এমন পাত্র হাতছাড়া করা তো ভীষণ বোকামী তার উপরে সবকিছু জেনেও যখন ওঁরা সব রাজী! দুপক্ষের কেউই দেরী না করে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ফেললো

.
বয়সে বছর আটের বড় প্রবাসী আপন চাচাতো ভাই এর সাথে সম্পর্কটা ছিলো সবসময়েই গুরুজন সদৃশ যে কারণে তার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরেও সহজ হতে পারেনি লোকটা সবসময়েই গম্ভীর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের এই কয়েকদিনেও এতটুকু স্বাভাবিক হতে পারেনি মনা আধুনিক মনমানসিকতা সম্পন্ন মনা ভেবেই নিয়েছে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে ওই দূরত্ব কেটে যাবে
বাসর রাত দুজনে বসে আছে খাটের উপর চুপচাপ গম্ভীর লোকটাকে চঞ্চল মনা কি করবে, কি বলবে ভেবে পেল না তাই চুপ করেই রইলো এভাবে কেটে গেলো অনেকটা সময়
রাত অনেক হয়ে এলো একসময় ওর কাজিন প্লাস হাজবেন্ড সাজিদ বলে উঠলো, “মনা, তুমি কি ভয় পাচ্ছ?”
ভয়?!” মনা বুঝতে পেলোনা, ভয়ের কি আছে! জড়ানো গলায় তখন কি বলে উঠলো, ঠিক শুনা গেলো না
: “ঠিক আছে তুমি ঘুমিয়ে পরোবলে উঠলো সাজিদ
মনা বেশ হতাশ হলো আহারে, কি এক নিরানন্দ বিবাহ বাসর! কোন কথা নেই ভাব ভালোবাসার কথা না জানুক লোকটা, অন্তত টুকটাক কোন কথা বলে ওর সাথে ভাব জমাতে বা ওর লজ্জা কাটানোর চেষ্টা তো করতে পারতোতা নয় ঘুমাও!”
মনা কি বলবে! কাত হয়ে এক পাশে ফিরে শুয়ে পরলো
ঘুমিয়ে পরেছিলো নাকি জেগে থাকতেই! ওর মনে হলো ওর বিয়ের পোশাক লেহেঙ্গার নিচের অংশে টানাটানি! ঘুমঘোরে বুঝতেই সময় লাগলো কিছুক্ষণ আছে কোথায়! সম্বিত ফিরে পেতেই হালকা আবছায়া অন্ধকারে যা দেখলো তাতে ওর বেহুঁশ হয়ে যাবার যোগাড়! প্রতিবাদের ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে! কিছুক্ষণ টানাটানি করেও সুবিধে করতে না পেরে ক্ষ্যান্ত দিল লোকটা লোকটা আর কেউ নয়! সাজিদ! ওর হবু বর!
সারা রাত্রী ভয়ে আর দুচোখের পাতা এক করতে পারলোনা মনা এতটুকু!!
আপন চাচার বাড়ি হওয়া সত্বেও মনা বাড়ির সাথে ততটা আন্তরিক নয় যেখানে কারো কাছে মনের আগল খুলে দিয়ে মনকে হালকা করা যায়
সারাদিন আত্মীয় স্বজনের মাঝে যেমন করে হোক কেটে গেলো নতুন বউয়ের রাতে ঘুমোবার আয়োজনে মনা কি বলবে ভেবে না পেয়ে বিছানা করে একপাশে শুয়ে পরলো আগের রাতের মতই নতুন শশুড় বাড়ির সারাদিনের ব্যস্ততায় ভীষণ ক্লান্ত ঘুমিয়ে পরলো সাথে সাথেই
অনেক রাতে আগের রাতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রথমে টের না পেলেও সামান্য পরেই বুঝতে পারলো আজ কি করে লোকটা ওর দেখার ইচ্ছে তাছাড়া, পুরুষের শরীরের ছোঁয়ায় নারীর একটু শিহরণ তো আছেই
আজ পেটিকোটের ফিতে খুলতে পেরেছে লোকটা। কিন্তু, কোন পূর্ব প্রস্তুতি নেই নেই কোন আনুষ্ঠানিক আহবান অযথাই ঘষাঘষি করলো কিছুক্ষণ! যা করতে চেয়েছিল তা করতে পারলো না এমনকি নিজেও বোধহয় কোন সুখ পেলোনা কি জানি কেন একটু পরেই দৌঁড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো
মনা বিছানায় শুয়ে অবাক হয়ে ভাবতে থাকলো, “বান্ধবীদের বাসরের সুন্দর সুন্দর কাহিনী শুনেছিলো ওর জীবনে এইসব কি হচ্ছে! তাও কোন অবুঝ অবলা অশিক্ষিত মেয়ে নয়!”
সাজিদ বের হয়ে এলো কিছুক্ষণ বাদে বাথরুম থেকে আর মনাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো, “রাগ করেছ মনা?” উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বলে উঠলো, “সরি এরকম আর হবে না

.
বিয়ের তিন দিন পরেই স্কুলে যেতে হয়েছে ছুটি ম্যানেজ করা যায়নি
অবশ্য, বিয়ের আবহটা মধুময় হলে মনা নিজেই আরো ছুটি দাবী করতো বা স্কুলের কামাই দিতো কিন্তু, এখন বরং স্কুলের ছুটি না পেয়ে বেঁচেই গেছে বাসা থেকে বেরিয়ে যতটা সময় ওকে বাইরে থাকতে হয় ততটা সময় স্বস্তিতেই থাকে যদিও শশুড় বাড়ির কারো প্রতি ওর কোন বিরক্তির অবকাশ নেই। শুধু আসল মানুষটার মধ্যেই যত বিপত্তি।
ডায়াবেটিকসের পেশেন্ট শাশুড়ির সার্বক্ষণিক সেবা করে যায় মাঝে মাঝে পেসাব-পায়খানাও পরিস্কার করতে হয় ওকে শাশুড়ির শশুড় বেঁচে নেই বাড়ির কারো প্রতি ওর কোন বিরক্তি নেই এমনকি সাজিদের সমস্যাটাও কাউকে বুঝতে দেয়না
প্রতি রাতেই সাজিদের অন্যায্য ব্যবহারে মানসিক শারিরীক ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে দিন যাপন করে চলেছে

.
লজ্জা শরম বাক্সে বন্দী করে বিয়ের তৃতীয় রাতেও যখন লোকটার কার্যক্রমে কোন পরিবর্তন পেলো না তখন বলে ফেলেছিলো, “দেখো, তোমার এই বিষয়ে প্রথমে একটু আলোচনা করে নেওয়া উচিত বিষয়টা ঠিক এইভাবেই করা উচিত নয় এভাবে আরো কিছু পয়েন্ট দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলো
এ বিষয়গুলো আসলে কিভাবে করা উচিত-অনুচিত। লজ্জায় রাঙা হয়ে ও বুঝাতে চাইছে। কিন্তু, ওর অমনোযোগী শ্রোতা সেটা শুনলে তো! ঘাড় আরেকদিক ঘুড়িয়ে রেখে জবাব দিলো, “আমি জানি। সব ঠিক হয়ে যাবে!”
কিন্তু, যে কে সেই রাত হলেই লোকটার মাথা খারাপ হয়ে যায়
বিয়ের দুই মাস এভাবেই কেটে গেলো এরপরে লোকটা চলে গেলো অস্ট্রেলিয়ায় এর পরের বার এসে নাকি মনাকে নিয়ে যাবে আসবে আবার  চার মাস পর

.
নামমাত্র এক বিয়ে হলো ওর হাজবেন্ড থেকেও নেই আর যে মাস থাকে তখন মনা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে তার চেয়ে যেন দূরে থাকে সেটাই কাম্য মফস্বল শহরের এক মেয়ের জন্য বিয়েটা খুব জরুরী ছিলো হয়েছে ওর পরিবার বেঁচে গেছে!
বিয়ের দুবছর পেরিয়ে যাবার পরেও লোকটার ভাবগতিক এতটুকু পাল্টাতে পারলো না এইবার নিয়ে তৃতীয়বার এলো লোকটা দেশে এখনও ওকে নিয়ে যাবার কোন ব্যবস্থা করতে পারলো না এখন শোনা যাচ্ছে আর নাকি ফিরেই যাবে না
ইদানিং বাসায় বেকার বসে থেকে থেকে সাজিদের কাছে ওর স্কুলের চাকরীটাও চক্ষুশুল হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কুল হতে ফিরতে একটু দেরী হলেই প্রচুর কথা শুনতে হয় বাসায় ফেরার পর মোবাইলটা জোর করে নিয়ে চেক করে সারাদিনে কার কার সাথে কথা হয়েছিলো কেউ ফোন করলেও আড়ালে লুকিয়ে ছাপিয়ে কথা শোনাটা এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে আর, শারিরীক সমস্যার জন্য ডাক্তার দেখানোর কথা বললে তো যা ব্যবহার করে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না

.
মনা বাবার বাড়িতে এসেছে কয়েকদিন হলো বড় বোনকে খুলে বললো যতটা পারে শুনে উনি বলে উঠলেন, “ নিজের সংসার; একটু মানিয়ে নে এক সময় ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু ধৈর্য্য ধরতে হয়! হাসানকে এখনও ভুলতে পারিসনি তাই এই রকম মনে হচ্ছে তোর কাছে!”
বুবুর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো মনা যে লোকটা বাসর রাতেই তার উপর হামলে পরেছিলো, যুগের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মুক্তমনা দিদিও তার উপরেই সব দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে বিয়ে হয়ে গেলে সবাইই কি বদলে যায় এমন!
অল্প কদিন তো নয়! দুই দুইটা বছর সে সহ্য করলো সবকিছু! ওর কলিগ, কাছের বন্ধু-বান্ধবের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলো আসলে সবার বক্তব্যকে যতটা প্রাধান্য দিবে, তার চেয়ে ওর নিজের মনটা বিষিয়ে উঠেছে বেশি এই লোকটার হাত থেকে মুক্তি চায়! একা থাকবে সেও ভালো কিন্তু, শারিরীক কষ্টের সাথে ইদানিং মানসিক সন্দেহের মাত্রা বেড়েছে সাজিদের বান্ধবীদের সাথে কথা বললেও আজেবাজে কথা বলে ওর স্কুলের পুরুষ কলিগদের নিয়েও কুৎসিত কথা বলতে ওর এতটুকু বাঁধে না
অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো ওর মুক্তি নিতে চাওয়া নিয়ে দুই বাড়ি থেকেই অনেক আপত্তি উঠলো ইন্টার পাশ, নিজের বয়সের চেয়েও অনেক বেশি বয়সী লোকটাকে বিশ্বাস করে সুন্দর সংসারের যে স্বপ্ন দেখেছিলো সেই সংসারের মাঝে কোন আনন্দই যেখানে পাচ্ছে না সেখানে এই দিনের পর দিন রাতের পর রাত এক ছাদের নিচে থাকার কি কোন মানে আছে! সমস্যা থাকা সত্বেও আপন পরিবারের একটা মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিতে যাদের বিবেকে এতটুকু বাঁধেনি, মনা আর তাদের কথা ভাববে না বিচ্ছেদের কাগজপত্র সব প্রস্তুত করে ফেলেছে কালই সেগুলো বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে
(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১২

সত্যগোপন ও সম্পর্কের পরিণতি!




.
: “কেমন আছ?”
: “হ্যাঁ এইতো আছি!”...দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে উঠে, “যেরকম থাকি তোমার খবর কি?”
: “আমি বাড়ি এসেছি তোমার সমস্যা কি মিটেছে?”
: “...নাহ! তো ডাক্তার দেখাতেই চায় না বলে আগেও নাকি দেখিয়েছে
: “আগে মানে কবে?”
: “ঐযে যখন অস্ট্রেলিয়ায় ছিলো তখন থাক বাদ দাও কথা” ...বলে আবারো ছোট একটা শ্বাস গোপনের চেষ্টা!!
: “তোমার কণ্ঠস্বর কেমন যেন শুনাচ্ছে কি হয়েছে বলো তো আমাকে
এরপরে কান্নার শব্দ শুনা যায় শুধু অনেকক্ষণ ধরে কোন কথা নেই মনার সমস্ত না বলা কথা যেন কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে স্রোতস্বীনি নদীর মত বয়ে চলল কিছুক্ষন
দাঁড়িয়ে আছে উজ্জ্বল জ্যোতস্নালোকিত বারান্দার এক কোনে, ঘরের লাইট নেভানো বারান্দার দরজাটা বাইরে থেকে সামান্য ভেজানো দরজার সাথে ওর বেড রুম কান্নার দমক কিছুটা হালকা হয়ে যাওয়ার পর খেয়াল করলো দরজার ফাঁকে একটা বিশাল ছায়া ওই ছায়া কার তা না দেখেও বলে দিতে পারে

.
মোবাইলে ফোন এসেছে মনা গোসল করতে করতে পানির শব্দ ছাপিয়ে শুনতে পেল একবার দুবার তিনবার বাজছে ওর নিজের ফোনকে করছে এতবার! জরুরী কিছু?”
অন্যদিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি গোসলখানা হতে বের হয়ে আসলো মনা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো, কোন মিসকল নেইকি ব্যাপার! আমি তো শুনলাম, আমার ফোন বাজছেবলে কল হিসটরি চেক করে দেখতে পেল ঠিকই তিনবার ফোন করেছিল শিমুল
শিমুল ফোন করেছিল! কেন?”
ভাবতে ভাবতে দেখলো, সাজিদ বারান্দা থেকে ঘরে প্রবেশ করছে চেহারায় কেমন যেন ভাব
এসে বসতেই মনা জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আমার ফোন ধরছিলা?”
-“হ্যাঁ দেখলাম
-“কেন?”
-“দেখলাম, কে ফোন করছে তোমাকে
শুনে রাগে গা জ্বলে উঠলো মনারঅনুপস্থিতিতে কারো জিনিসে নজর বুলানো যে ঠিক না তা তুমি জানো না?”
সাজিদ কিছু না বলে উঠে চলে গেলো
ঘরে শাশুড়ি আর সাজিদের কথোপকথনের শব্দ শুনতে পেল সে

.
: “তোমরা আগামীকাল মুক্তিসেনা কবিতাটি মুখস্ত করে আসবে
: “জ্বী, আপা
ক্লাসের ঘন্টা পরলে মনা ব্যাগ গুছিয়ে হেঁটে টিচার কমন রুমে চলে আসলো
:“কিরে মনা, মুখ শুকনো কেমন আছিস?”
:“নাসিমা আপা, এভাবে আর চলে না
:“ তুই তোর হাজবেন্ডকে বুঝা ভালো করে বুঝালে সে নিশ্চয়ই একসময় বুঝবে।“
কিভাবে বুঝাবে? আর কতবার! কতভাবে! বিয়ের দুবছর পেরিয়ে গেছে!” উত্তরটা দিল মনে মনে, “ বুঝাতে বুঝাতে লুছনী হয়ে যাচ্ছি!”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানপিটে তুখোড় ছাত্রী ছিলো মনা অনার্স, মাস্টার্সে প্লেস নিয়ে পাশ করেছে জীবনের কোন অধ্যায়ে সেকেন্ড ডিভিশন নেই খুব সুন্দরী না হলেও নজর কাড়তো সবারই সিনিয়র জুনিয়র অনেক ছেলেরই স্বপ্নে হানা দিতো অনেকেরই ঘুম হারাম করে দেওয়া মনার ব্যক্তিগত জীবনে ভালোবাসার বিশেষ একজন ছিলো অন্য সব মেয়ের মতই বিশ্ববিদ্যালয় পাশের পর ঘর বাঁধার স্বপ্ন ছিলো ওরও কিন্তু, কোন এক অজ্ঞাত কারণে হাসানের সাথে ওর বিয়েটা হলো না
হাসান অন্যত্র বিয়ে করে ফেললো ওকে না জানিয়েই। বিয়ে করে হাসান খুশি থাকলেও মনা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলো ওকে নিয়ে বাবা-মার চিন্তার শেষ ছিলো না কি করবে, কোথায় বিয়ে দিয়ে মেয়েটার জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে দুজনে পৃথিবী ছাড়তে পারবে সেই ভাবনা ছিলো সবসময়
এর মধ্যে মনার বাবা হালিম সাহেবের বড়ভাইয়ের বউ বড় ছেলেকে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য দেশে ফিরলে ওঁরা মনাকে দেখে মুগ্ধ হয় মনা তখন প্রেমের বেদনা ভুলে কিছুটা ধাতস্থ বিয়ের ব্যাপারে নিজেও একটু আগ্রহী
তারপর আর কি! ছেলে বাইরে থাকে, সেখানকার ওষুধ কম্পানীতে চাকরী করে, বছরে দুবার দেশে আসে মফস্বল শহরের মেয়ের জন্য এমন পাত্র হাতছাড়া করা তো ভীষণ বোকামী তার উপরে সবকিছু জেনেও যখন ওঁরা সব রাজী! দুপক্ষের কেউই দেরী না করে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ফেললো

.
বয়সে বছর আটের বড় প্রবাসী আপন চাচাতো ভাই এর সাথে সম্পর্কটা ছিলো সবসময়েই গুরুজন সদৃশ যে কারণে তার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরেও সহজ হতে পারেনি লোকটা সবসময়েই গম্ভীর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের এই কয়েকদিনেও এতটুকু স্বাভাবিক হতে পারেনি মনা আধুনিক মনমানসিকতা সম্পন্ন মনা ভেবেই নিয়েছে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে ওই দূরত্ব কেটে যাবে
বাসর রাত দুজনে বসে আছে খাটের উপর চুপচাপ গম্ভীর লোকটাকে চঞ্চল মনা কি করবে, কি বলবে ভেবে পেল না তাই চুপ করেই রইলো এভাবে কেটে গেলো অনেকটা সময়
রাত অনেক হয়ে এলো একসময় ওর কাজিন প্লাস হাজবেন্ড সাজিদ বলে উঠলো, “মনা, তুমি কি ভয় পাচ্ছ?”
ভয়?!” মনা বুঝতে পেলোনা, ভয়ের কি আছে! জড়ানো গলায় তখন কি বলে উঠলো, ঠিক শুনা গেলো না
: “ঠিক আছে তুমি ঘুমিয়ে পরোবলে উঠলো সাজিদ
মনা বেশ হতাশ হলো আহারে, কি এক নিরানন্দ বিবাহ বাসর! কোন কথা নেই ভাব ভালোবাসার কথা না জানুক লোকটা, অন্তত টুকটাক কোন কথা বলে ওর সাথে ভাব জমাতে বা ওর লজ্জা কাটানোর চেষ্টা তো করতে পারতোতা নয় ঘুমাও!”
মনা কি বলবে! কাত হয়ে এক পাশে ফিরে শুয়ে পরলো
ঘুমিয়ে পরেছিলো নাকি জেগে থাকতেই! ওর মনে হলো ওর বিয়ের পোশাক লেহেঙ্গার নিচের অংশে টানাটানি! ঘুমঘোরে বুঝতেই সময় লাগলো কিছুক্ষণ আছে কোথায়! সম্বিত ফিরে পেতেই হালকা আবছায়া অন্ধকারে যা দেখলো তাতে ওর বেহুঁশ হয়ে যাবার যোগাড়! প্রতিবাদের ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে! কিছুক্ষণ টানাটানি করেও সুবিধে করতে না পেরে ক্ষ্যান্ত দিল লোকটা লোকটা আর কেউ নয়! সাজিদ! ওর হবু বর!
সারা রাত্রী ভয়ে আর দুচোখের পাতা এক করতে পারলোনা মনা এতটুকু!!
আপন চাচার বাড়ি হওয়া সত্বেও মনা বাড়ির সাথে ততটা আন্তরিক নয় যেখানে কারো কাছে মনের আগল খুলে দিয়ে মনকে হালকা করা যায়
সারাদিন আত্মীয় স্বজনের মাঝে যেমন করে হোক কেটে গেলো নতুন বউয়ের রাতে ঘুমোবার আয়োজনে মনা কি বলবে ভেবে না পেয়ে বিছানা করে একপাশে শুয়ে পরলো আগের রাতের মতই নতুন শশুড় বাড়ির সারাদিনের ব্যস্ততায় ভীষণ ক্লান্ত ঘুমিয়ে পরলো সাথে সাথেই
অনেক রাতে আগের রাতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রথমে টের না পেলেও সামান্য পরেই বুঝতে পারলো আজ কি করে লোকটা ওর দেখার ইচ্ছে তাছাড়া, পুরুষের শরীরের ছোঁয়ায় নারীর একটু শিহরণ তো আছেই
আজ পেটিকোটের ফিতে খুলতে পেরেছে লোকটা। কিন্তু, কোন পূর্ব প্রস্তুতি নেই নেই কোন আনুষ্ঠানিক আহবান অযথাই ঘষাঘষি করলো কিছুক্ষণ! যা করতে চেয়েছিল তা করতে পারলো না এমনকি নিজেও বোধহয় কোন সুখ পেলোনা কি জানি কেন একটু পরেই দৌঁড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো
মনা বিছানায় শুয়ে অবাক হয়ে ভাবতে থাকলো, “বান্ধবীদের বাসরের সুন্দর সুন্দর কাহিনী শুনেছিলো ওর জীবনে এইসব কি হচ্ছে! তাও কোন অবুঝ অবলা অশিক্ষিত মেয়ে নয়!”
সাজিদ বের হয়ে এলো কিছুক্ষণ বাদে বাথরুম থেকে আর মনাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো, “রাগ করেছ মনা?” উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বলে উঠলো, “সরি এরকম আর হবে না

.
বিয়ের তিন দিন পরেই স্কুলে যেতে হয়েছে ছুটি ম্যানেজ করা যায়নি
অবশ্য, বিয়ের আবহটা মধুময় হলে মনা নিজেই আরো ছুটি দাবী করতো বা স্কুলের কামাই দিতো কিন্তু, এখন বরং স্কুলের ছুটি না পেয়ে বেঁচেই গেছে বাসা থেকে বেরিয়ে যতটা সময় ওকে বাইরে থাকতে হয় ততটা সময় স্বস্তিতেই থাকে যদিও শশুড় বাড়ির কারো প্রতি ওর কোন বিরক্তির অবকাশ নেই। শুধু আসল মানুষটার মধ্যেই যত বিপত্তি।
ডায়াবেটিকসের পেশেন্ট শাশুড়ির সার্বক্ষণিক সেবা করে যায় মাঝে মাঝে পেসাব-পায়খানাও পরিস্কার করতে হয় ওকে শাশুড়ির শশুড় বেঁচে নেই বাড়ির কারো প্রতি ওর কোন বিরক্তি নেই এমনকি সাজিদের সমস্যাটাও কাউকে বুঝতে দেয়না
প্রতি রাতেই সাজিদের অন্যায্য ব্যবহারে মানসিক শারিরীক ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে দিন যাপন করে চলেছে

.
লজ্জা শরম বাক্সে বন্দী করে বিয়ের তৃতীয় রাতেও যখন লোকটার কার্যক্রমে কোন পরিবর্তন পেলো না তখন বলে ফেলেছিলো, “দেখো, তোমার এই বিষয়ে প্রথমে একটু আলোচনা করে নেওয়া উচিত বিষয়টা ঠিক এইভাবেই করা উচিত নয় এভাবে আরো কিছু পয়েন্ট দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলো
এ বিষয়গুলো আসলে কিভাবে করা উচিত-অনুচিত। লজ্জায় রাঙা হয়ে ও বুঝাতে চাইছে। কিন্তু, ওর অমনোযোগী শ্রোতা সেটা শুনলে তো! ঘাড় আরেকদিক ঘুড়িয়ে রেখে জবাব দিলো, “আমি জানি। সব ঠিক হয়ে যাবে!”
কিন্তু, যে কে সেই রাত হলেই লোকটার মাথা খারাপ হয়ে যায়
বিয়ের দুই মাস এভাবেই কেটে গেলো এরপরে লোকটা চলে গেলো অস্ট্রেলিয়ায় এর পরের বার এসে নাকি মনাকে নিয়ে যাবে আসবে আবার  চার মাস পর

.
নামমাত্র এক বিয়ে হলো ওর হাজবেন্ড থেকেও নেই আর যে মাস থাকে তখন মনা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে তার চেয়ে যেন দূরে থাকে সেটাই কাম্য মফস্বল শহরের এক মেয়ের জন্য বিয়েটা খুব জরুরী ছিলো হয়েছে ওর পরিবার বেঁচে গেছে!
বিয়ের দুবছর পেরিয়ে যাবার পরেও লোকটার ভাবগতিক এতটুকু পাল্টাতে পারলো না এইবার নিয়ে তৃতীয়বার এলো লোকটা দেশে এখনও ওকে নিয়ে যাবার কোন ব্যবস্থা করতে পারলো না এখন শোনা যাচ্ছে আর নাকি ফিরেই যাবে না
ইদানিং বাসায় বেকার বসে থেকে থেকে সাজিদের কাছে ওর স্কুলের চাকরীটাও চক্ষুশুল হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কুল হতে ফিরতে একটু দেরী হলেই প্রচুর কথা শুনতে হয় বাসায় ফেরার পর মোবাইলটা জোর করে নিয়ে চেক করে সারাদিনে কার কার সাথে কথা হয়েছিলো কেউ ফোন করলেও আড়ালে লুকিয়ে ছাপিয়ে কথা শোনাটা এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে আর, শারিরীক সমস্যার জন্য ডাক্তার দেখানোর কথা বললে তো যা ব্যবহার করে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না

.
মনা বাবার বাড়িতে এসেছে কয়েকদিন হলো বড় বোনকে খুলে বললো যতটা পারে শুনে উনি বলে উঠলেন, “ নিজের সংসার; একটু মানিয়ে নে এক সময় ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু ধৈর্য্য ধরতে হয়! হাসানকে এখনও ভুলতে পারিসনি তাই এই রকম মনে হচ্ছে তোর কাছে!”
বুবুর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো মনা যে লোকটা বাসর রাতেই তার উপর হামলে পরেছিলো, যুগের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মুক্তমনা দিদিও তার উপরেই সব দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে বিয়ে হয়ে গেলে সবাইই কি বদলে যায় এমন!
অল্প কদিন তো নয়! দুই দুইটা বছর সে সহ্য করলো সবকিছু! ওর কলিগ, কাছের বন্ধু-বান্ধবের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলো আসলে সবার বক্তব্যকে যতটা প্রাধান্য দিবে, তার চেয়ে ওর নিজের মনটা বিষিয়ে উঠেছে বেশি এই লোকটার হাত থেকে মুক্তি চায়! একা থাকবে সেও ভালো কিন্তু, শারিরীক কষ্টের সাথে ইদানিং মানসিক সন্দেহের মাত্রা বেড়েছে সাজিদের বান্ধবীদের সাথে কথা বললেও আজেবাজে কথা বলে ওর স্কুলের পুরুষ কলিগদের নিয়েও কুৎসিত কথা বলতে ওর এতটুকু বাঁধে না
অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো ওর মুক্তি নিতে চাওয়া নিয়ে দুই বাড়ি থেকেই অনেক আপত্তি উঠলো ইন্টার পাশ, নিজের বয়সের চেয়েও অনেক বেশি বয়সী লোকটাকে বিশ্বাস করে সুন্দর সংসারের যে স্বপ্ন দেখেছিলো সেই সংসারের মাঝে কোন আনন্দই যেখানে পাচ্ছে না সেখানে এই দিনের পর দিন রাতের পর রাত এক ছাদের নিচে থাকার কি কোন মানে আছে! সমস্যা থাকা সত্বেও আপন পরিবারের একটা মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিতে যাদের বিবেকে এতটুকু বাঁধেনি, মনা আর তাদের কথা ভাববে না বিচ্ছেদের কাগজপত্র সব প্রস্তুত করে ফেলেছে কালই সেগুলো বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে
(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন