রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১২

মিছিল

পেয়ারার ডালে পা ঝুলিয়ে কে বসে আছে তা অনুমান করতে খুব একটা কষ্ট হলো না। বিচ্ছুটা সারাদিন ঐ পেয়ারার ডালে বসে গরুর জাবর কাটার মত পেয়ারা চিবাবে।

- এই নীলু, নিরো কোথায়রে? পেয়ারার ডাল ধরে একটু ঝুকে নীলু আমার দিকে তাকায়
- জানি না, দেখো গিয়ে কার উপকার করতে গেছে নিজের খেয়ে নীলুর কথা শুনলে মাঝে মাঝে গা জ্বলে।
এতটুকুন একটা মেয়ে সে কিনা বড়দের মত কথা বলে। নিরোটাকে খুব দরকার। কোথায় যে এখন খুজি! এলাকায় আছে, না অন্য এলাকায় আছে- কে জানে!
নিরো আমাদের বিচ্ছুদলের মধ্যে একেবারেই আলাদা। বাবা-মা নেই। নিজের মত করে বড় হয়েছে বলেই কিনা জানি না, তবে ওর মনটা বড় নরম। যেখানেই কোন মানুষের বিপদ-আপদের কথা শুনবে, ও ছুটে যাবে।


ওদিকে নীলুটা চঞ্চল। সারাদিন হাসি হাসি মুখ নিয়ে পেয়ারা চিবাবে। ইদানিং বড় মানুষের মত কথা বলা শুরু করেছে। কথায় কথায় উপদেশ দেবে। আর আছে রনি, প্রমি, ইফতি।

রনিটা একটু বোকা সোকা। ওকে পশ্চীমে যেতে বললে, আগে সূর্যের দিকে তাকাবে। তারপর ডান হাত ধরে বলবে, মাহি এইটা ডান হাত না? আমি হাসি, হ্যাঁ ডান হাত… - ও তাহলে এদিকেই পশ্চীম। আচ্ছা যাই…

প্রমি পুরো উলটো। এমনিতেই ওর গাল দুটো লাল হয়ে থাকে সারাক্ষণ, যেন মনে হয় মাস্টার মশায়ের চড় খেয়েছে মাত্রই। প্রতিদিনই দেখি কি এক লম্বা বড় এক খসখসে পাতা জোগাড় করে আনে। তারপর সেটাকে ছেচে লালচে রঙ বের করে গালে ঠোঁটে মাখে। আমার খুব ইচ্ছে করে ওর গালে বিছুটি পাতা মেখে দেই।

ইফতির মোটাসোটা শরীর দেখলেই মনে হয়ে সারা শরীরের চিপায় চাপায় কি না কি লুকিয়ে রেখেছে। সারাক্ষণই ওর মুখ নড়তেই থাকে।

আমার অস্থির লাগছে। নিরোকে না পেলে চলছেই না। রনি আর নিরোটা ইদানিং বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে। দু’জনকে প্রায়ই ফিসফাস করতে দেখি। কি যে কি করে! কিছুই বলে না। ইফতিটাও লাপাত্তা। ও ব্যাটার নড়াচরা নেই, সারাদিন শুধু খাই খাই। প্রায়ই দেখা যায় নীলু পেয়ারা গাছে আর ও গাছের তলায় দাঁড়িয়ে হা করে উপরের দিকে চেয়ে আছে। যেন নীলু একটা পেয়ারা ফেওললেই টপ করে গিলে ফেলবে। মোটুটা গাছে চড়তেও শেখে নাই। বিকেল প্রায় পড়ে এলো। সবার আজ আসার কথা। অথচ কারো কোন পাত্তাই নেই।

আমি নীলুর কাছ থেকে একটা পেয়ারা নিয়ে খেতে খেতে দেখি দূরে রনি আর নিরো আসছে। কিছুক্ষনের মধ্যে প্রমি আর রনিও চলে আসে। নিরো পাশের এলাকার আশফাকের মাকে দেখতে গিয়েছিলো। সবাই আসতেই আমাদের আড্ডা শুরু হলো। আগের মতো আমাদের আর দেখা হয় না।
গত কিছুদিন ধরে চারিদিকে বেশ একটা গরম অবস্থা। আগের মত তাই আমরা মাঠে খেলতে পারি না, ঘুরতে পারি না। আমরা যে কথা বলি, শুনেছি আমরা নাকি এমন করে বলতে পারবো না। উর্দুতে বলতে হবে। এটা কোন কথা হলো! নিরো তো শুনেই ক্ষেপে গেলো।
- শালার জিন্নাহ হারামজ়াদাকে যদি কাঁচা তেলাপোকা না খাওয়াইছি, নইলে আমার নাম নিরো না

আমি ওকে থামাই। আমার নিজেরও খুব রাগ হয়। বড়রা এই সময়ে অনেক কিছু ভাবে, কথা বলে। আমিও একটু একটু শুনি। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করে আমরাও কিছু একটা করি। কিন্তু কোন বুদ্ধি পাই না। নিরো আনমনা হয়ে পরে। সময় গুলো আমাদের ভালো কাটে না। আমরা কি ঘরে চুপ করে বসে থাকবো! সে কি হয়! কিন্তু আমরা অনেক চিন্তা করেও কোন বুদ্ধি পাই না। বড়রা কত কিছু করছে আর আমরা কিনা ঘরে বসে থাকবো! তাই কি হয়!

ইদানিং চারিদিকে খুব মিছিল-মিটিং হচ্ছে। ঘরের ভেতর থেকে আমি উত্তেজনায় মরি। ভাষার জন্য মিছিল করে কি হবে। আমার বাবা বাংলায় কথা বলে, মা বলে, আমিও বলি। সবাই তো বাংলায় কথা বলে। তাহলে কিভাবে কেড়ে নেবে ভাষা। আমার মাথায় ঢোকে না! রাতে বাবা বুঝিয়ে দিতেই আমি বুঝতে পারি। আমার অনেক রাগ হয় নিরোর মতো।

রনীল আর নিরোটা দিন দিন এড়িয়ে চলছিল। কিছুতেই ওদের নাগাল আর পাই না। কোথায় যায়, কি করে, কে জানে! ওদের ছাড়াই আমি, প্রমি, ইফতি আর বিচ্ছু নীলুটা মিলে পেয়েরা গাছতলায় আড্ডা দেই। মাঝে মাঝে খেলার চেষ্টা করি। কিন্তু কোন কিছুই জমে না।
হঠাৎ সেদিন রাতে রনির ডাক শুনলাম। চাপা সুরে আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি প্রথমে বুঝতেই পারি নাই। এতরাতে কেইবা আমাকে ডাকতে যাবে! রনি ঘরের জানলায় এসে টোকা দেয়। ফিসফিস করে বলে,
- এই মাহি, মাহি। একটু বের হবি… আমি অন্ধকার দেখি।

বাবা টের পেলে আমাকে তো আস্ত গিলে খাবে। তবু আমি যাবার লোভ সামলাতে পারি না। খুব সন্তপর্ণে বেড়িয়ে আসি। - কি হয়েছে, তুই এত রাতে! বাড়িতে বলে এসেছিস?
- রাখ তোর বাড়ির কথা। দেখ কি এনেছি…
আমি ভীরু চোখে আশেপাশে তাকাই। বাবা বের হয় কিনা। রনি কোমরের পিছনে গুজে রাখা একটা ভাজ করা কাগজ বের করে। আমি ওর হাত থেকে নিয়ে মেলে ধরি। “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”
- তুই কোথায় পেলি এটা?
- পেয়েছি। চল যাবি
- কোথায় যাবো? আগে বল তুই কোথায় পেয়েছিস?
- সবসময় ফ্যাচফ্যাচ করিস। আমি এনেছি।
- তুই! - হ্যাঁ, আমি মামার ড্র্য়ার থেকে মেরে দিয়েছি। নিরো বললো, মিছিল করবে। আমার মামা কয়েকদিন ধরে এগুলো বানাচ্ছে। নিরোকে বলতেই বললো, একটা জোগার কর। আমরাও মিছিলে যাবো। এখন নিরো গেছে প্রমি, নীলু আর ইফতিকে আনতে। ওরা স্কুল ঘরের কাছে থাকবে।
- নীলু, প্রমি…
আমার আর কথা বের হয় না! আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। রনির চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে।
রনি তারা দেয়,
- এত কথা বলিস না, যাবি যদি চল। কাল মিছিল হবে।
আমি রনির সাথে পা বাড়াই। সত্যি কি কাল মিছিল হবে!

২১ তারিখ সকালে ভোর হতেই মিছিলের শব্দ পাই। সবার কন্ঠে ভাষার দাবি। আমি বাবার কথা চিন্তা করি। আমাকে সকালে দেখতে না পেয়ে নিশ্চই খুব চিন্তা করছে। কিন্তু বলে আসতে গেলেতো আসতে পারতাম না। কিছু একটা করতে চাইতাম, নিরোটাই পথ দেখালো।
গতরাতে নিরো আর রনি মিলে অনেক গুলো পোস্টার সাইজ কাগজ আর কালি এনেছে। ইফতিও বসে থাকেনি। ওর গন্ডে গন্ডে খাওয়া ফেলে কোত্থেকে যেন বাঁশের চটা এনেছে। নীলু সারারাত প্রয়োজন মতো কালি গুলে দিয়েছে, আঠা লাগিয়েছে। অতটুকন একটা মেয়ে সারারাত না ঘুমিয়ে একটানা কাজ করে গেলো! প্রমি আর আমি পোস্টার একেঁছি। নিরো আর রনি স্লোগান গুলো লিখে দিচ্ছিল। সেই সব স্লোগান যা এতদিন মুখে মুখে শুনেছি।

রোদ ভালো করে ফোটার আগেই আমরা রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ি। হাতে পোস্টার, ফেস্টুন। দলে ভারী হতে সময় লাগলো না। মিছিলে মিছিলে আমরা অংশ হয়ে যাই, মিছিলে। নিরো বিরবির করে কি যেন বলছিল। আমি তাকাতেই অ চুপ হয়ে যায়।

- কিরে কি বলিস?
- কই! কিছু না। মার কথা মনে পড়ছে রে…

আমি চুপ হয়ে যাই। সবার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি। সবার মাঝে চাপা উত্তেজনা ফেটে পড়তে চাইছে। সামনে আর একটা মোড় ঘুরেই ঢাকা ভার্সিটি দেখা যাবে। বাড়ি থেকে প্রায়ই এদিকে আসতাম আমরা। সেদিকে যেতেই বড় রকমের জটলা দেখি। আমরা এগিয়ে যাই। কখন যে মিছিলের সাথে গলা মিলিয়ে আমরাও স্লোগান দিতে শুরু করেছি, খেয়ালি করি নাই। খন্ড খন্ড মিছিল গুলো একত্রিত হচ্ছে। স্লোগানে স্লোগানে চারিদিক এক উত্তাল গর্জন।
“রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই।“


হঠাৎ দেখি কয়েকটা পুলিশের গাড়ি সামনের রাস্তায় বেষ্টনী তৈরী করে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই মনে পড়লো, আজ না ১৪৪ ধারা। বাবা বলেছিল, আজ কোথাও মিছিল-মিটীং করা যাবে না। তাহলে পুলিশ গুলি করবে। নিরো, রনি, প্রমি, ইফতি, নীলু সবাই সমানে স্লোগান দিচ্ছে। রনি আমার পাশেই ছিলো। ওর বোকা সোকা মুখের জায়গায় এমন সংগ্রামী মুখ আমি মেলাতে পারি না।
- এই রনি…
আমি জোরে বলি। রনিও সমান জোরে বলে…
- কি! স্লোগান দিচ্ছিস না কেনো?
- আজ তো ১৪৪ ধারা - তাতে কি?
- পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ওরা নাকি মিছিল দেখলেই গুলি করবে…

আমি কথাটা বলে শেষ করতে পারলাম কিনা, আমি জানি না। গুলির শব্দে আমি কেঁপে উঠি। আমার গায়ের উপর রনি আছড়ে পরে। গুলিটা ওর লেগেছে। মাথার একপাশ উড়ে গেছে রনির। ওর রক্তে আমার সারা শরীর ভাসে যাচ্ছে। প্রমি, নীলু, নিরো কে খুঁজি। কাউকে পাই না। চারিদিকে মিছিলরত মানুষ গুলো দিক-বেদিক ছুটছে। থেমে থেমে একটানা গুলির শব্দ, আর মরা চিৎকার। কেউ কেউ অতি সাহসী হয়ে তুলে নিচ্ছে কাছেই থাকা কারো ভাই, বন্ধু বা সহপাঠির লাশ। আমি অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু রনির লাশ তুলতে পারলাম না।

কে আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসলো বলতে পারবো না। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে আমার চেনা বিছানায়ই পেলাম। প্রমি, নীলু, ইফতি বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে।
- এখন কেমন লাগছে তোর? প্রমি জিজ্ঞেস করে।
মাথা নেড়ে জানালাম, ভালো। চোখের সামনে রনির রক্ত মাথা মুখটা মনে পড়লো। কেমন ভাবলেশহীন নির্ভীক মুখ। একটু কষ্টও হয়নি ওর মরতে।বুলেটের কি এতই শক্তি, এত সহজেই মেরে ফেলতে পারে কাউকে।
আমি বাতাসে প্রশ্ন ছাড়ি,
- নিরো কোথায়? কোন উত্তর নেই।
- কিরে কিছু বলছিস না কেন, নিরো কই?
প্রমি মুখ খোলে,
- জানি না। মিছিলে গোলাগুলি শুরু হতেই সবাই যে যেদিক পারলো ছুটলো। আমি নীলুর হাত ধরে ইফতির সাথে ডান পাশের রাস্তা দিয়ে দৌড়ে আসি। আসার সময় এক পলক নিরোকে দেখেছি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে শেল কুড়াচ্ছে, ছুড়ে মারছে পুলিশ গুলোর দিকে। চিৎকার করে কি যেন বলছিলো, শুধু একবার শুনতে পেলাম “মা”। তারপর কি হয়েছে জানি না।

আমি থ হয়ে যাই। নীলুটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে, ইফতিও। ওদের সোখে পানি দেখি। আমি কাঁদি না। আমি ভাষাহীন। রনিটা মরে গেছে। নিরো! নিরো কোথায় কেউ জানে না।

আমার ছোট ছেলের মেয়েটা বায়না ধরেছে ২১শে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ মিনারে ফুল দেবে। শুনে আমার বুক জুড়ে প্রশান্তি ভর করে। ভাষা শহীদের অনেকগুলো নাম ঐ ছোট মুখটায় শুনি। কান পেতে থাকি রনি বা নিরোর নামটা একবার উচ্চারিত হবে। আমার আশাভঙ্গ হয়। প্রতি বছর এই ফেব্রুয়ারীর ২১ তারিখ এলেই আমার বুকের ক্ষতটায় নতুন করে ব্যাথা হয়। রনির সেই ছোট মুখটা ভাসে। ওর কবরে ফুল দিতে গিয়ে বলি, এই বোকা ডান-বাম চিনতে পারলি না! একটু ডানে সরে গেলি না কেন! গুলিটা আমার লাগতো!

অনেক খুঁজেছি নিরোকে। যারা মরেছে তাদের কবর হয়েছে, সবাই ফুল দেয়। নিরোর কোন কবর নেই। নিরোকে এখনো চোখের সামনে দেখি, রাস্তায় ছুটে গিয়ে শেল কুড়াচ্ছে, ছুড়ে মারছে। তারপর সত্যি ও যেমন হারিয়ে গেছে তেমন করে মিলিয়ে যায়। আমি প্রায়ই খুঁজি, সব কবরস্থানে। মাঝে মাঝে রনিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, নিরোর কোন খবর পেলো কিনা! রনি বলেছে, খবর পেলে জানাবে। ২১ আসে ২১ যায়, বছর যায়। নিরোর আজো খবর মেলেনি। নিরোকে পাইনি। ওকে মনে পড়লেই ওর প্রিয় কবিতা পড়ি। এই তো নিরো, এইখানে…


মিছিল হলেই হারিয়ে যেতে হয়।

পায়ের স্যান্ডেল ছুড়ে ফেলে
নগ্ন পায়ে কাঁটা পাড়িয়ে
রক্তাক্ত হতে হয়।
তবেই সেই রক্তাক্ত ছাপ গুনে
আসবে আরো, অগণিত, হাজারো
মিছিল।
তাই মিছিল হলেই
ঘরে ঘরে তালা ঝুলবে,
গায়ের শার্ট খুলতেই হবে পোস্টার-
প্রতিটি স্লোগান
আজ গলা ছিড়ে বুর্জোয়ার বুকে
মারবে লাথি।
বুকের মাঝে রক্তের সাগর
ঢেউ হয়ে রাস্তায় দেবে আলপনা,
ভাবনা কিসে! সব খুলি ফাটা মাথায়
বাঁধা থাকবে বিজয় পতাকা
লাল।

তাই মিছিল হলেই হারিয়ে যেতে হয়।।

২টি মন্তব্য:

  1. গল্পটি কোথায় যেন পড়েছিলাম বলে মনে হচ্ছে! গল্পকবিতাডটকম-এর একুশে ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় কি? ... অসাধারণ গল্প! যেন গল্প নয়, একটি মুক্তিযুদ্ধের নাটক উপভোগ করলাম !

    উত্তরমুছুন
  2. পোস্ট পছন্দ হলে কিসে চাপ দিয়ে সেটা জানানো যায়? সেই বাটন পাচ্ছিনা! এই পোস্টটি পছন্দ হয়েছে।

    উত্তরমুছুন

রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১২

মিছিল

পেয়ারার ডালে পা ঝুলিয়ে কে বসে আছে তা অনুমান করতে খুব একটা কষ্ট হলো না। বিচ্ছুটা সারাদিন ঐ পেয়ারার ডালে বসে গরুর জাবর কাটার মত পেয়ারা চিবাবে।

- এই নীলু, নিরো কোথায়রে? পেয়ারার ডাল ধরে একটু ঝুকে নীলু আমার দিকে তাকায়
- জানি না, দেখো গিয়ে কার উপকার করতে গেছে নিজের খেয়ে নীলুর কথা শুনলে মাঝে মাঝে গা জ্বলে।
এতটুকুন একটা মেয়ে সে কিনা বড়দের মত কথা বলে। নিরোটাকে খুব দরকার। কোথায় যে এখন খুজি! এলাকায় আছে, না অন্য এলাকায় আছে- কে জানে!
নিরো আমাদের বিচ্ছুদলের মধ্যে একেবারেই আলাদা। বাবা-মা নেই। নিজের মত করে বড় হয়েছে বলেই কিনা জানি না, তবে ওর মনটা বড় নরম। যেখানেই কোন মানুষের বিপদ-আপদের কথা শুনবে, ও ছুটে যাবে।


ওদিকে নীলুটা চঞ্চল। সারাদিন হাসি হাসি মুখ নিয়ে পেয়ারা চিবাবে। ইদানিং বড় মানুষের মত কথা বলা শুরু করেছে। কথায় কথায় উপদেশ দেবে। আর আছে রনি, প্রমি, ইফতি।

রনিটা একটু বোকা সোকা। ওকে পশ্চীমে যেতে বললে, আগে সূর্যের দিকে তাকাবে। তারপর ডান হাত ধরে বলবে, মাহি এইটা ডান হাত না? আমি হাসি, হ্যাঁ ডান হাত… - ও তাহলে এদিকেই পশ্চীম। আচ্ছা যাই…

প্রমি পুরো উলটো। এমনিতেই ওর গাল দুটো লাল হয়ে থাকে সারাক্ষণ, যেন মনে হয় মাস্টার মশায়ের চড় খেয়েছে মাত্রই। প্রতিদিনই দেখি কি এক লম্বা বড় এক খসখসে পাতা জোগাড় করে আনে। তারপর সেটাকে ছেচে লালচে রঙ বের করে গালে ঠোঁটে মাখে। আমার খুব ইচ্ছে করে ওর গালে বিছুটি পাতা মেখে দেই।

ইফতির মোটাসোটা শরীর দেখলেই মনে হয়ে সারা শরীরের চিপায় চাপায় কি না কি লুকিয়ে রেখেছে। সারাক্ষণই ওর মুখ নড়তেই থাকে।

আমার অস্থির লাগছে। নিরোকে না পেলে চলছেই না। রনি আর নিরোটা ইদানিং বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে। দু’জনকে প্রায়ই ফিসফাস করতে দেখি। কি যে কি করে! কিছুই বলে না। ইফতিটাও লাপাত্তা। ও ব্যাটার নড়াচরা নেই, সারাদিন শুধু খাই খাই। প্রায়ই দেখা যায় নীলু পেয়ারা গাছে আর ও গাছের তলায় দাঁড়িয়ে হা করে উপরের দিকে চেয়ে আছে। যেন নীলু একটা পেয়ারা ফেওললেই টপ করে গিলে ফেলবে। মোটুটা গাছে চড়তেও শেখে নাই। বিকেল প্রায় পড়ে এলো। সবার আজ আসার কথা। অথচ কারো কোন পাত্তাই নেই।

আমি নীলুর কাছ থেকে একটা পেয়ারা নিয়ে খেতে খেতে দেখি দূরে রনি আর নিরো আসছে। কিছুক্ষনের মধ্যে প্রমি আর রনিও চলে আসে। নিরো পাশের এলাকার আশফাকের মাকে দেখতে গিয়েছিলো। সবাই আসতেই আমাদের আড্ডা শুরু হলো। আগের মতো আমাদের আর দেখা হয় না।
গত কিছুদিন ধরে চারিদিকে বেশ একটা গরম অবস্থা। আগের মত তাই আমরা মাঠে খেলতে পারি না, ঘুরতে পারি না। আমরা যে কথা বলি, শুনেছি আমরা নাকি এমন করে বলতে পারবো না। উর্দুতে বলতে হবে। এটা কোন কথা হলো! নিরো তো শুনেই ক্ষেপে গেলো।
- শালার জিন্নাহ হারামজ়াদাকে যদি কাঁচা তেলাপোকা না খাওয়াইছি, নইলে আমার নাম নিরো না

আমি ওকে থামাই। আমার নিজেরও খুব রাগ হয়। বড়রা এই সময়ে অনেক কিছু ভাবে, কথা বলে। আমিও একটু একটু শুনি। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করে আমরাও কিছু একটা করি। কিন্তু কোন বুদ্ধি পাই না। নিরো আনমনা হয়ে পরে। সময় গুলো আমাদের ভালো কাটে না। আমরা কি ঘরে চুপ করে বসে থাকবো! সে কি হয়! কিন্তু আমরা অনেক চিন্তা করেও কোন বুদ্ধি পাই না। বড়রা কত কিছু করছে আর আমরা কিনা ঘরে বসে থাকবো! তাই কি হয়!

ইদানিং চারিদিকে খুব মিছিল-মিটিং হচ্ছে। ঘরের ভেতর থেকে আমি উত্তেজনায় মরি। ভাষার জন্য মিছিল করে কি হবে। আমার বাবা বাংলায় কথা বলে, মা বলে, আমিও বলি। সবাই তো বাংলায় কথা বলে। তাহলে কিভাবে কেড়ে নেবে ভাষা। আমার মাথায় ঢোকে না! রাতে বাবা বুঝিয়ে দিতেই আমি বুঝতে পারি। আমার অনেক রাগ হয় নিরোর মতো।

রনীল আর নিরোটা দিন দিন এড়িয়ে চলছিল। কিছুতেই ওদের নাগাল আর পাই না। কোথায় যায়, কি করে, কে জানে! ওদের ছাড়াই আমি, প্রমি, ইফতি আর বিচ্ছু নীলুটা মিলে পেয়েরা গাছতলায় আড্ডা দেই। মাঝে মাঝে খেলার চেষ্টা করি। কিন্তু কোন কিছুই জমে না।
হঠাৎ সেদিন রাতে রনির ডাক শুনলাম। চাপা সুরে আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি প্রথমে বুঝতেই পারি নাই। এতরাতে কেইবা আমাকে ডাকতে যাবে! রনি ঘরের জানলায় এসে টোকা দেয়। ফিসফিস করে বলে,
- এই মাহি, মাহি। একটু বের হবি… আমি অন্ধকার দেখি।

বাবা টের পেলে আমাকে তো আস্ত গিলে খাবে। তবু আমি যাবার লোভ সামলাতে পারি না। খুব সন্তপর্ণে বেড়িয়ে আসি। - কি হয়েছে, তুই এত রাতে! বাড়িতে বলে এসেছিস?
- রাখ তোর বাড়ির কথা। দেখ কি এনেছি…
আমি ভীরু চোখে আশেপাশে তাকাই। বাবা বের হয় কিনা। রনি কোমরের পিছনে গুজে রাখা একটা ভাজ করা কাগজ বের করে। আমি ওর হাত থেকে নিয়ে মেলে ধরি। “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”
- তুই কোথায় পেলি এটা?
- পেয়েছি। চল যাবি
- কোথায় যাবো? আগে বল তুই কোথায় পেয়েছিস?
- সবসময় ফ্যাচফ্যাচ করিস। আমি এনেছি।
- তুই! - হ্যাঁ, আমি মামার ড্র্য়ার থেকে মেরে দিয়েছি। নিরো বললো, মিছিল করবে। আমার মামা কয়েকদিন ধরে এগুলো বানাচ্ছে। নিরোকে বলতেই বললো, একটা জোগার কর। আমরাও মিছিলে যাবো। এখন নিরো গেছে প্রমি, নীলু আর ইফতিকে আনতে। ওরা স্কুল ঘরের কাছে থাকবে।
- নীলু, প্রমি…
আমার আর কথা বের হয় না! আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। রনির চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে।
রনি তারা দেয়,
- এত কথা বলিস না, যাবি যদি চল। কাল মিছিল হবে।
আমি রনির সাথে পা বাড়াই। সত্যি কি কাল মিছিল হবে!

২১ তারিখ সকালে ভোর হতেই মিছিলের শব্দ পাই। সবার কন্ঠে ভাষার দাবি। আমি বাবার কথা চিন্তা করি। আমাকে সকালে দেখতে না পেয়ে নিশ্চই খুব চিন্তা করছে। কিন্তু বলে আসতে গেলেতো আসতে পারতাম না। কিছু একটা করতে চাইতাম, নিরোটাই পথ দেখালো।
গতরাতে নিরো আর রনি মিলে অনেক গুলো পোস্টার সাইজ কাগজ আর কালি এনেছে। ইফতিও বসে থাকেনি। ওর গন্ডে গন্ডে খাওয়া ফেলে কোত্থেকে যেন বাঁশের চটা এনেছে। নীলু সারারাত প্রয়োজন মতো কালি গুলে দিয়েছে, আঠা লাগিয়েছে। অতটুকন একটা মেয়ে সারারাত না ঘুমিয়ে একটানা কাজ করে গেলো! প্রমি আর আমি পোস্টার একেঁছি। নিরো আর রনি স্লোগান গুলো লিখে দিচ্ছিল। সেই সব স্লোগান যা এতদিন মুখে মুখে শুনেছি।

রোদ ভালো করে ফোটার আগেই আমরা রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ি। হাতে পোস্টার, ফেস্টুন। দলে ভারী হতে সময় লাগলো না। মিছিলে মিছিলে আমরা অংশ হয়ে যাই, মিছিলে। নিরো বিরবির করে কি যেন বলছিল। আমি তাকাতেই অ চুপ হয়ে যায়।

- কিরে কি বলিস?
- কই! কিছু না। মার কথা মনে পড়ছে রে…

আমি চুপ হয়ে যাই। সবার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি। সবার মাঝে চাপা উত্তেজনা ফেটে পড়তে চাইছে। সামনে আর একটা মোড় ঘুরেই ঢাকা ভার্সিটি দেখা যাবে। বাড়ি থেকে প্রায়ই এদিকে আসতাম আমরা। সেদিকে যেতেই বড় রকমের জটলা দেখি। আমরা এগিয়ে যাই। কখন যে মিছিলের সাথে গলা মিলিয়ে আমরাও স্লোগান দিতে শুরু করেছি, খেয়ালি করি নাই। খন্ড খন্ড মিছিল গুলো একত্রিত হচ্ছে। স্লোগানে স্লোগানে চারিদিক এক উত্তাল গর্জন।
“রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই।“


হঠাৎ দেখি কয়েকটা পুলিশের গাড়ি সামনের রাস্তায় বেষ্টনী তৈরী করে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই মনে পড়লো, আজ না ১৪৪ ধারা। বাবা বলেছিল, আজ কোথাও মিছিল-মিটীং করা যাবে না। তাহলে পুলিশ গুলি করবে। নিরো, রনি, প্রমি, ইফতি, নীলু সবাই সমানে স্লোগান দিচ্ছে। রনি আমার পাশেই ছিলো। ওর বোকা সোকা মুখের জায়গায় এমন সংগ্রামী মুখ আমি মেলাতে পারি না।
- এই রনি…
আমি জোরে বলি। রনিও সমান জোরে বলে…
- কি! স্লোগান দিচ্ছিস না কেনো?
- আজ তো ১৪৪ ধারা - তাতে কি?
- পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ওরা নাকি মিছিল দেখলেই গুলি করবে…

আমি কথাটা বলে শেষ করতে পারলাম কিনা, আমি জানি না। গুলির শব্দে আমি কেঁপে উঠি। আমার গায়ের উপর রনি আছড়ে পরে। গুলিটা ওর লেগেছে। মাথার একপাশ উড়ে গেছে রনির। ওর রক্তে আমার সারা শরীর ভাসে যাচ্ছে। প্রমি, নীলু, নিরো কে খুঁজি। কাউকে পাই না। চারিদিকে মিছিলরত মানুষ গুলো দিক-বেদিক ছুটছে। থেমে থেমে একটানা গুলির শব্দ, আর মরা চিৎকার। কেউ কেউ অতি সাহসী হয়ে তুলে নিচ্ছে কাছেই থাকা কারো ভাই, বন্ধু বা সহপাঠির লাশ। আমি অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু রনির লাশ তুলতে পারলাম না।

কে আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসলো বলতে পারবো না। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে আমার চেনা বিছানায়ই পেলাম। প্রমি, নীলু, ইফতি বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে।
- এখন কেমন লাগছে তোর? প্রমি জিজ্ঞেস করে।
মাথা নেড়ে জানালাম, ভালো। চোখের সামনে রনির রক্ত মাথা মুখটা মনে পড়লো। কেমন ভাবলেশহীন নির্ভীক মুখ। একটু কষ্টও হয়নি ওর মরতে।বুলেটের কি এতই শক্তি, এত সহজেই মেরে ফেলতে পারে কাউকে।
আমি বাতাসে প্রশ্ন ছাড়ি,
- নিরো কোথায়? কোন উত্তর নেই।
- কিরে কিছু বলছিস না কেন, নিরো কই?
প্রমি মুখ খোলে,
- জানি না। মিছিলে গোলাগুলি শুরু হতেই সবাই যে যেদিক পারলো ছুটলো। আমি নীলুর হাত ধরে ইফতির সাথে ডান পাশের রাস্তা দিয়ে দৌড়ে আসি। আসার সময় এক পলক নিরোকে দেখেছি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে শেল কুড়াচ্ছে, ছুড়ে মারছে পুলিশ গুলোর দিকে। চিৎকার করে কি যেন বলছিলো, শুধু একবার শুনতে পেলাম “মা”। তারপর কি হয়েছে জানি না।

আমি থ হয়ে যাই। নীলুটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে, ইফতিও। ওদের সোখে পানি দেখি। আমি কাঁদি না। আমি ভাষাহীন। রনিটা মরে গেছে। নিরো! নিরো কোথায় কেউ জানে না।

আমার ছোট ছেলের মেয়েটা বায়না ধরেছে ২১শে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ মিনারে ফুল দেবে। শুনে আমার বুক জুড়ে প্রশান্তি ভর করে। ভাষা শহীদের অনেকগুলো নাম ঐ ছোট মুখটায় শুনি। কান পেতে থাকি রনি বা নিরোর নামটা একবার উচ্চারিত হবে। আমার আশাভঙ্গ হয়। প্রতি বছর এই ফেব্রুয়ারীর ২১ তারিখ এলেই আমার বুকের ক্ষতটায় নতুন করে ব্যাথা হয়। রনির সেই ছোট মুখটা ভাসে। ওর কবরে ফুল দিতে গিয়ে বলি, এই বোকা ডান-বাম চিনতে পারলি না! একটু ডানে সরে গেলি না কেন! গুলিটা আমার লাগতো!

অনেক খুঁজেছি নিরোকে। যারা মরেছে তাদের কবর হয়েছে, সবাই ফুল দেয়। নিরোর কোন কবর নেই। নিরোকে এখনো চোখের সামনে দেখি, রাস্তায় ছুটে গিয়ে শেল কুড়াচ্ছে, ছুড়ে মারছে। তারপর সত্যি ও যেমন হারিয়ে গেছে তেমন করে মিলিয়ে যায়। আমি প্রায়ই খুঁজি, সব কবরস্থানে। মাঝে মাঝে রনিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, নিরোর কোন খবর পেলো কিনা! রনি বলেছে, খবর পেলে জানাবে। ২১ আসে ২১ যায়, বছর যায়। নিরোর আজো খবর মেলেনি। নিরোকে পাইনি। ওকে মনে পড়লেই ওর প্রিয় কবিতা পড়ি। এই তো নিরো, এইখানে…


মিছিল হলেই হারিয়ে যেতে হয়।

পায়ের স্যান্ডেল ছুড়ে ফেলে
নগ্ন পায়ে কাঁটা পাড়িয়ে
রক্তাক্ত হতে হয়।
তবেই সেই রক্তাক্ত ছাপ গুনে
আসবে আরো, অগণিত, হাজারো
মিছিল।
তাই মিছিল হলেই
ঘরে ঘরে তালা ঝুলবে,
গায়ের শার্ট খুলতেই হবে পোস্টার-
প্রতিটি স্লোগান
আজ গলা ছিড়ে বুর্জোয়ার বুকে
মারবে লাথি।
বুকের মাঝে রক্তের সাগর
ঢেউ হয়ে রাস্তায় দেবে আলপনা,
ভাবনা কিসে! সব খুলি ফাটা মাথায়
বাঁধা থাকবে বিজয় পতাকা
লাল।

তাই মিছিল হলেই হারিয়ে যেতে হয়।।

২টি মন্তব্য:

  1. গল্পটি কোথায় যেন পড়েছিলাম বলে মনে হচ্ছে! গল্পকবিতাডটকম-এর একুশে ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় কি? ... অসাধারণ গল্প! যেন গল্প নয়, একটি মুক্তিযুদ্ধের নাটক উপভোগ করলাম !

    উত্তরমুছুন
  2. পোস্ট পছন্দ হলে কিসে চাপ দিয়ে সেটা জানানো যায়? সেই বাটন পাচ্ছিনা! এই পোস্টটি পছন্দ হয়েছে।

    উত্তরমুছুন